দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার কিংবদন্তি রজনীকান্তের বহুল প্রতীক্ষিত ছবি ‘কুলি’ আজ বিশ্বব্যাপী তামিল, তেলুগু এবং হিন্দি ভাষায় মুক্তি পেয়েছে। লোকেশ কানাগরাজের পরিচালনায় নির্মিত এই অ্যাকশন-থ্রিলারটি মুক্তির প্রথম দিনেই প্রেক্ষাগৃহে দর্শকদের উন্মাদনা ছড়িয়েছে। রজনীকান্তের অতুলনীয় স্ক্রিন উপস্থিতি, তারকাবহুল কাস্ট, এবং অনিরুদ্ধ রবিচন্দ্রের মুগ্ধকর সঙ্গীত ছবিটিকে স্বাধীনতা দিবসের উৎসবের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। তবে, সমালোচকদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া এবং পাইরেসির চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, ছবিটি বক্স অফিসে শক্তিশালী শুরু করেছে।
গল্প ও অভিনয়: রজনীকান্তের দাপট
‘কুলি’ বন্দরকেন্দ্রিক স্বর্ণ পাচার এবং অপরাধী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে একজন শ্রমিক নেতার সংগ্রামের গল্প বুনে এগিয়েছে। রজনীকান্ত এখানে ‘দেবরাজ’ ওরফে ‘দেবা’ চরিত্রে অভিনয় করেছেন, যিনি আবেগ, দৃঢ়তা এবং অ্যাকশনের অপূর্ব মিশ্রণে দর্শকদের মন জয় করেছেন। তাঁর তিন মিনিটের একক সংলাপ দৃশ্যটি প্রেক্ষাগৃহে দর্শকদের মধ্যে তুমুল হর্ষধ্বনি সৃষ্টি করেছে। লোকেশ কানাগরাজের হাই-অকটেন অ্যাকশন কোরিওগ্রাফি এবং গিরিশ গঙ্গাধরণের দৃষ্টিনন্দন চিত্রগ্রহণ ছবিটিকে দৃশ্যত সমৃদ্ধ করেছে। তবে, দ্বিতীয়ার্ধে গল্পের গতি এবং সম্পাদনার কিছু অসঙ্গতি নিয়ে সমালোচকদের কিছুটা অভিযোগ রয়েছে।
ছবিতে রজনীকান্তের পাশাপাশি নাগার্জুনা (সাইমন জেভিয়ার), উপেন্দ্র (কালীশা), শ্রুতি হাসান (প্রীতি), এবং সৌবিন শাহির (দয়ালন) অভিনয় দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। আমির খানের ক্যামিও উপস্থিতি এবং পূজা হেগড়ের ‘মনিকা’ গানে বিশেষ ভূমিকা ছবিতে অতিরিক্ত আকর্ষণ যোগ করেছে। শ্রুতি হাসানের অ্যাকশন-নির্ভর চরিত্রটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যা তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম শক্তিশালী পারফরম্যান্স হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অনিরুদ্ধের ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর এবং ‘মনিকা’ গানটি ইতিমধ্যে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, যা ছবির জনপ্রিয়তায় ইন্ধন যোগাচ্ছে।
বক্স অফিসে দুর্দান্ত শুরু
‘কুলি’ মুক্তির আগেই অগ্রিম টিকিট বিক্রিতে ২০ কোটি রুপির রেকর্ড গড়েছিল। প্রথম দিনের বিশ্বব্যাপী আয় প্রায় ১৩০ কোটি রুপির কাছাকাছি পৌঁছেছে, যা তামিল সিনেমার অন্যতম বড় ওপেনিং হলেও বিজয়ের ‘লিও’র রেকর্ড (১৪৮ কোটি) ভাঙতে পারেনি। ভারতে প্রথম দিনের নেট আয় ছিল ৪৬.৫২ কোটি, তামিলনাড়ুতে আসনদখলের হার ৮৪% ছাড়িয়েছে। উত্তর আমেরিকা, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডে দর্শকদের উৎসাহ ছিল অভূতপূর্ব। দীর্ঘ স্বাধীনতা দিবসের উইকএন্ডের সুবিধা কাজে লাগিয়ে ছবিটি ৬০০ কোটি রুপির ক্লাবে প্রবেশ করতে পারে বলে ব্যবসায়িক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
ওটিটি, স্যাটেলাইট এবং সঙ্গীতের স্বত্ব বিক্রি থেকে ইতিমধ্যে ২৫০ কোটি রুপির বেশি আয় নিশ্চিত হয়েছে। ৩৭৫ কোটি রুপির বাজেটে নির্মিত এই ছবিটি রজনীকান্তের ৫০ বছরের ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বড় হিট হওয়ার পথে এগিয়ে চলেছে।
পাইরেসির চ্যালেঞ্জ
মুক্তির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ‘কুলি’র পাইরেটেড কপি অনলাইনে ছড়িয়ে পড়েছে, যা প্রযোজকদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে, শক্তিশালী প্রেক্ষাগৃহ উপস্থিতি এবং দর্শকদের উৎসাহ এই চ্যালেঞ্জকে ছাপিয়ে ছবির বাণিজ্যিক সাফল্যকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রযোজনা সংস্থা সান পিকচার্স পাইরেসির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছে।
দর্শক ও সমালোচকদের প্রতিক্রিয়া
দর্শকরা সামাজিক মাধ্যমে রজনীকান্তের অভিনয় এবং লোকেশের স্টাইলিশ নির্মাণের প্রশংসায় মুখর। একজন ভক্ত লিখেছেন, “রজনীকান্তের এনার্জি এই বয়সেও অপ্রতিরোধ্য। লোকেশের গল্প এবং অনিরুদ্ধের সঙ্গীত ‘কুলি’কে অবিস্মরণীয় করে তুলেছে।” তবে, কিছু সমালোচক দ্বিতীয়ার্ধের গতিহীনতা এবং গল্পের কিছু অংশকে ‘অপ্রত্যাশিতভাবে সাধারণ’ বলে মন্তব্য করেছেন। ট্রেলারে প্রত্যাশিত উত্তেজনার তুলনায় ছবির কিছু অংশ কম প্রভাব ফেললেও, ‘ইন্টারভ্যাল ব্লক’ এবং ক্যামিও মুহূর্তগুলো দর্শকদের মধ্যে তুমুল উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করেছে।
রজনীকান্তের ব্যক্তিগত সংযোগ
ট্রেলার প্রকাশ অনুষ্ঠানে রজনীকান্ত তাঁর জীবনের কুলি হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। তিনি জানান, একবার তাঁর কলেজের বন্ধু তাঁকে চিনতে না পেরে লাগেজ বহনের জন্য দুই রুপি দিয়েছিলেন, যা তাঁর জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। এই অভিজ্ঞতা তাঁর চরিত্রে প্রাণ সঞ্চার করেছে, যা দর্শকদের সঙ্গে গভীরভাবে সংযোগ স্থাপন করেছে।
বক্স অফিসে প্রতিযোগিতা
‘কুলি’ একই দিনে মুক্তি পাওয়া অয়ন মুখার্জির ‘ওয়ার ২’-এর সঙ্গে বক্স অফিসে তুমুল প্রতিযোগিতায় নেমেছে। তবে, অগ্রিম বুকিংয়ে ‘কুলি’ উত্তর আমেরিকায় ‘ওয়ার ২’-এর তুলনায় চার গুণ বেশি টিকিট বিক্রি করেছে। তামিলনাড়ু এবং তেলেগু রাজ্যগুলোতে ছবিটির আধিপত্য অটুট, যদিও হিন্দি বাজারে এটি তুলনামূলকভাবে কম প্রভাব ফেলতে পারে।
সমাপ্তি
‘কুলি’ শুধু একটি অ্যাকশন ছবি নয়, এটি রজনীকান্তের জীবনের প্রতিফলন এবং তাঁর অদম্য চেতনার প্রকাশ। লোকেশ কানাগরাজের নির্মাণ দক্ষতা, তারকাবহুল কাস্ট, এবং অনিরুদ্ধের তালমাতাল সঙ্গীত ছবিটিকে বড় পর্দায় একটি উৎসবমুখর অভিজ্ঞতায় রূপান্তরিত করেছে। পাইরেসির চ্যালেঞ্জ এবং গল্পের কিছু অসমতা সত্ত্বেও, ‘কুলি’ প্রেক্ষাগৃহে দর্শকদের মন জয় করেছে এবং বক্স অফিসে রেকর্ড গড়ার পথে এগিয়ে চলেছে। স্বাধীনতা দিবসের উইকএন্ডে এটি দর্শকদের জন্য একটি নিখাদ বিনোদনের উৎসব হয়ে উঠেছে।
তথ্যসূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান টাইমস, ইন্ডিয়া টুডে, দ্য উইক, পিঙ্কভিলা, এবং সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত দর্শক ও সমালোচকদের প্রতিক্রিয়া। পরিসংখ্যান প্রাথমিক, প্রযোজকদের চূড়ান্ত হিসাবের উপর নির্ভরশীল।