ঐতিহ্যের আড়ালে দুর্ভোগ: কবি নজরুল কলেজের ছাত্রাবাসে চরম মানবেতর জীবন

INFO TODAY বাংলা

 


মো: হোসেন,  কবি নজরুল সরকারি কলেজ, প্রতিনিধি | | ২৩ আগস্ট ২০২৫, শনিবার


অধিগ্রহণের জটিলতায় সমাধান আটকে আছে। মানবেতর পরিবেশে বসবাস করছে কবি নজরুল সরকারি কলেজের দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী। পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জের শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী মঙ্গলাবাস প্রাসাদটি প্রায় পাঁচ দশক ধরে এই কলেজের একমাত্র ছাত্রাবাস 'শহীদ শামসুল আলম হল' হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু ইতিহাস আর ঐতিহ্যের এই স্থাপনায় দেড় শতাধিক শিক্ষার্থীর জীবন এখন সংকটাপন্ন। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, বিশুদ্ধ পানির অভাব, ঝুঁকিপূর্ণ আবাসন ও প্রশাসনের উদাসীনতায় তাদের শিক্ষাজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।


কুয়ার পানি আর পলিথিনের ছাউনি: দুর্ভোগের চিত্র

ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এই প্রাসাদটির মূল মালিক ছিলেন জমিদার যতীন্দ্র কুমার সাহা। দেশভাগের পর এটি পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে এটি কবি নজরুল কলেজের ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদ এ কলেজের ছাত্র শামসুল আলমের নামে নামকরণ করা হয়।

কিন্তু নামকরণের পরও এর অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। সরেজমিনে দেখা গেছে, আধুনিক যুগেও এখানে শিক্ষার্থীরা কুয়ার পানির ওপর নির্ভরশীল। সরবরাহ লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানি থাকে না, ফলে গোসল ও শৌচকর্মের জন্য তাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। দেড় শতাধিক শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র একটি পানি বিশুদ্ধকরণ ফিল্টার রয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

বর্ষা এলে দুর্ভোগ আরও বাড়ে। প্রায় প্রতিটি কক্ষের ছাদ থেকে পানি পড়ে, ফলে অনেক শিক্ষার্থীর বইখাতা ও বিছানাপত্র ভিজে নষ্ট হয়। দীর্ঘ সংস্কারের অভাবে দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে, যার কারণে অনেকে দুর্ঘটনার ভয়ে পলিথিনের ছাউনি দিয়ে ঘুমান।


অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি

দেড় শতাধিক শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র চারটি ব্যবহার অনুপযোগী শৌচাগার রয়েছে। ছাত্রাবাসের ভেতরে-বাইরে ময়লার স্তূপ থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায়। শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন, ডাইনিংয়ে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার রান্না করা হয়। আবাসন সংকটের কারণে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী একসঙ্গে থাকতে বাধ্য হওয়ায় স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। সম্প্রতি এক সপ্তাহেই প্রায় ত্রিশজন শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়েছে বলে জানা গেছে।

এছাড়াও, ছাত্রাবাসের সামনে একটি ক্লাবের উচ্চ শব্দে গানবাজনা ও আড্ডা শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছে।


ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য, অনিশ্চিত সমাধান

এই দুরবস্থা থেকে মুক্তি পেতে গত ১৯ মে শিক্ষার্থীরা জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কার্যালয় ঘেরাও করে। তখন অধিগ্রহণের আশ্বাস দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।

এ বিষয়ে ছাত্রাবাসের বাসিন্দা মনিরুজ্জামান মারুফ বলেন, "এই হলে প্রতিদিন বেঁচে থাকাটাই একটা চ্যালেঞ্জ। প্রশাসনকে বারবার জানিয়েও কোনো লাভ হয়নি। প্রতিবারই হেরিটেজ আর সরকারি বরাদ্দের অজুহাত শুনতে হয়।"

আরেক শিক্ষার্থী মুন্না বলেন, "ছাত্রাবাসটির কোনো স্থায়ী অভিভাবক নেই। আমরা এমন একজন অভিভাবক চাই যিনি আমাদের সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করবেন।"

অন্যদিকে, কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান জানান, ভবনটি কলেজের নামে না থাকায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে না। তবে তিনি আশা প্রকাশ করেন, ২৫ তারিখের শুনানির পর ভবনটি কলেজের নামে বরাদ্দ হলে নতুন ভবন নির্মাণ সম্ভব হবে।

কিন্তু ঢাকা জেলা প্রশাসক তানভীর আহমেদ অধ্যক্ষের বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, অধিগ্রহণের শর্ত কঠিন হওয়ায় কলেজ প্রশাসন এর জন্য আবেদন করবে না বলে জানিয়েছে। এর পরিবর্তে তারা লিজের জন্য আবেদন করেছে। তিনি বর্তমান লিজ গ্রহীতাদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান।

কলেজ ও জেলা প্রশাসনের এই পরস্পর বিরোধী বক্তব্যে অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া আরও দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। একদিকে ঐতিহ্য রক্ষার আইন, অন্যদিকে অর্পিত সম্পত্তির জটিলতা—এই দুইয়ের কারণে দেড় শতাধিক শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত।

সত্যের সাথে, সময়ের সাথে – ইনফো টুডে বাংলা

সময়োপযোগী খবর ও তথ্যভিত্তিক আপডেট শেয়ার করার একটি নির্ভরযোগ্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম
To Top