নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল: নজরদারি এড়ানোর কৌশল ও রাজনৈতিক তাৎপর্য

INFO TODAY বাংলা

ঢাকা, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ – বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কঠোর নজরদারি এবং নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিল (ফ্ল্যাশ প্রোটেস্ট) চালিয়ে যাচ্ছে। এই মিছিলগুলো সাধারণত ৫-৩০ মিনিট স্থায়ী হয় এবং দ্রুত ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়, যা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে। এই প্রতিবেদনে ঝটিকা মিছিলের কৌশল, এর পেছনের কারণ এবং রাজনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণ করা হলো।

পটভূমি

১২ মে ২০২৫-এ মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আওয়ামী লীগকে অ্যান্টি-টেররিজম অ্যাক্টের অধীনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত দলটির সকল রাজনৈতিক কার্যক্রম স্থগিত রাখার নির্দেশ দেয়। এরপর থেকে আওয়ামী লীগের প্রায় ৫ লাখ নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার বা হামলার শিকার হলেও দলটি তাদের উপস্থিতি জানান দিতে ঝটিকা মিছিলের মাধ্যমে সক্রিয় রয়েছে।

নজরদারি এড়ানোর কৌশল

আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কঠোর নজরদারি (স্মার্ট ফোন ট্র্যাকিং, সিসিটিভি, ইন্টেলিজেন্স সার্ভেইলেন্স) এড়াতে একাধিক কৌশল অবলম্বন করছে:

আকস্মিক ও দ্রুত মিছিল: এই মিছিলগুলো পূর্বপরিকল্পিত না হয়ে হঠাৎ শুরু হয় এবং অল্প সময়ে শেষ হয়। উদাহরণস্বরূপ, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ হাজারীবাগে ময়লার ডিপোর সামনে ১৫-২০ জনের একটি দল ব্যানার নিয়ে মিছিল করে এবং ৫ মিনিটের মধ্যে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়, যার ফলে পুলিশ পৌঁছানোর আগেই তারা পালিয়ে যায়।

ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আড়াল: অনেক মিছিল জুমার নামাজ বা মিলাদ মাহফিলের পরে আয়োজিত হয়, যা ধর্মীয় সমাবেশ হিসেবে বিবেচিত হয়। ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ ধানমন্ডিতে জুমার নামাজের পর একটি মিছিল অনুষ্ঠিত হয়, যা নজরদারি এড়াতে সক্ষম হয়।
স্থানীয় সমর্থন ও গোপন যোগাযোগ: নেতা-কর্মীরা স্থানীয় সমর্থকদের বাড়িতে আশ্রয় নেয় এবং হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ বা মুখোমুখি যোগাযোগের মাধ্যমে সংগঠিত হয়। পুলিশের সতর্কতা (যেমন: আওয়ামী লীগের নেতাদের আশ্রয় না দেওয়ার নির্দেশ) সত্ত্বেও স্থানীয় সমর্থন তাদের শক্তি যোগায়। ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ বেতার ভবনের সামনে একটি মিছিল স্থানীয়দের সহযোগিতায় সফল হয়।
ছোট দল ও ছত্রভঙ্গ: মিছিলে ১৫-৫০ জন অংশ নেয়, যা বড় সমাবেশের তুলনায় কম নজরে পড়ে। তারা দ্রুত সাধারণ মানুষের ভিড়ে মিশে যায়। সাম্প্রতিক X পোস্টে দেখা যায়, তেজগাঁও, ধানমন্ডি, গুলশানে এমন মিছিল প্রায় প্রতিদিন হচ্ছে।
প্রযুক্তি এড়ানোর কৌশল: ফোনের GPS বন্ধ রাখা, অফলাইন ম্যাপ বা সিগন্যাল জ্যামার ব্যবহার করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের পূর্ববর্তী সরকারী নজরদারি অভিজ্ঞতা (যেমন: IMSI ক্যাচার) তাদের এই কৌশল বাস্তবায়নে সহায়তা করছে।

মিছিলের উদ্দেশ্য

আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল কেবল প্রতিবাদ নয়, বরং রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কৌশল। 


প্রধান উদ্দেশ্যগুলো হলো


অস্তিত্বের জানান দেওয়া: নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দলটি বিলুপ্ত হয়নি, এটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রমাণ করা। X-এ সাংবাদিক সারাহ খানের পোস্টে বলা হয়, "এই মিছিলগুলো ছোট হলেও দলের অস্তিত্বের জানান এবং সরকারের দমনমূলক নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।"

কর্মীদের মনোবল বৃদ্ধি: গ্রেপ্তার ও হামলা সত্ত্বেও মিছিলগুলো কর্মীদের উৎসাহিত করছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আওয়ামী লীগের X পোস্টে বলা হয়, "ঝটিকা থেকে হাজারের মিছিল, শীঘ্রই লাখোর মিছিলে রূপ নেবে।"
রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি: মিছিলগুলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করছে, বিশেষ করে ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এর নির্বাচনের আগে। এটি বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করছে এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন (যেমন: ভারত) আকর্ষণ করছে।
প্রতিবাদের দাবি: শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার, সরকারের পদত্যাগ এবং ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি এই মিছিলের মূল বিষয়।

সাম্প্রতিক ঘটনাবলি

নিচে সেপ্টেম্বর ২০২৫-এর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঝটিকা মিছিলের বিবরণ দেওয়া হলো:

  • তারিখ
  • স্থান
  • বিবরণ
  • ফলাফল (গ্রেপ্তার/ঘটনা)
  • ৫ সেপ্টেম্বর
  • তেজগাঁও, ধানমন্ডি, মহাম্মদপুর
  • জুমার নামাজের পর মিছিল; শেখ হাসিনার ছবি ও "জয় বাংলা" স্লোগান।
  • ৮ জন গ্রেপ্তার, ককটেল বিস্ফোরণ।
  • ১২ সেপ্টেম্বর
  • দারুসসালাম, বাংলামোটর
  • প্রস্তুতি পর্যায়ে আটক; স্লোগান: "জয় বঙ্গবন্ধু"।
  • ১২ জন গ্রেপ্তার।
  • ১৩ সেপ্টেম্বর
  • আগারগাঁও
  • বাংলাদেশ বেতার ভবনের সামনে মিছিল; ১০০+ অংশগ্রহণকারী।
  • ২ জন গ্রেপ্তার।
  • ১৬ সেপ্টেম্বর
  • ঢাকার বিভিন্ন এলাকা
  • গোয়েন্দা পুলিশের অভিযানে আটক।
  • ১২ জন গ্রেপ্তার।
  • ১৮ সেপ্টেম্বর
  • হাজারীবাগ
  • ৫ মিনিটের মিছিল; বেড়িবাঁধ এলাকায়।
  • ১১ জন গ্রেপ্তার।

চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ প্রভাব

এই ঝটিকা মিছিলগুলো স্থানীয় উত্তেজনা বাড়াচ্ছে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। পুলিশের অভিযান (যেমন: থানায় কড়া নির্দেশ) সত্ত্বেও মিছিল সম্পূর্ণ বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। আন্তর্জাতিকভাবে, বিশেষ করে ভারতের সমর্থন এই মিছিলগুলোর মাধ্যমে শক্তিশালী হচ্ছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নির্বাচন দেরি হলে এই মিছিলগুলো বৃহৎ আন্দোলনে রূপ নিতে পারে।

উপসংহার

আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল কেবল প্রতিবাদ নয়, বরং রাজনৈতিক টিকে থাকার একটি কৌশল। নজরদারি এড়ানোর দক্ষতা এবং স্থানীয় সমর্থন তাদের এই কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে সহায়তা করছে। তবে, এই মিছিলগুলো দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং আসন্ন নির্বাচনের উপর কী প্রভাব ফেলবে, তা এখনও অস্পষ্ট।

সূত্র: প্রথম আলো, বিডিনিউজ২৪, দ্য ডেইলি স্টার, অ্যালজাজিরা, X পোস্ট (সারাহ খান, আওয়ামী লীগ অফিশিয়াল)।

সত্যের সাথে, সময়ের সাথে – ইনফো টুডে বাংলা

সময়োপযোগী খবর ও তথ্যভিত্তিক আপডেট শেয়ার করার একটি নির্ভরযোগ্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম
To Top