নীলফামারীর, রংপুর | মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
নীলফামারীর উত্তরা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ইপিজেড) একটি কারখানা বন্ধের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে শ্রমিকদের বিক্ষোভের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে এক শ্রমিক নিহত এবং প্রায় ৫০ জন আহত হয়েছেন।
ঘটনাটি ঘটেছে মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, সকাল ৮টার দিকে উত্তরা ইপিজেডের এভারগ্রিন (বিডি) লিমিটেড কারখানার সামনে। নিহত শ্রমিক মো. হাবিবুর রহমান (২১) ইকু ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি নিটিং কারখানার কর্মী ছিলেন। তিনি নীলফামারী সদর উপজেলার সংগলশী ইউনিয়নের কাজীরহাট গ্রামের দুলাল হোসেনের ছেলে।
স্থানীয় সূত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে জানা গেছে, হংকংভিত্তিক এভারগ্রিন কারখানা কর্তৃপক্ষ প্রায় ৫০ জন শ্রমিককে ছাঁটাই করে এবং তাদের পাওনা বেতন ও সুবিধা পরিশোধ না করে কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধের নোটিশ জারি করে। এর প্রতিবাদে শ্রমিকরা সকালে কারখানার প্রধান ফটকে জড়ো হন এবং নীলফামারী-সৈয়দপুর মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেন। তারা অন্য কারখানার শ্রমিকদেরও কাজে যোগ দিতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এই পরিস্থিতিতে পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে শ্রমিকদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ শুরু হয়। শ্রমিকরা দাবি করেন, তাদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করে এবং গুলি চালায়, যার ফলে হাবিবুর রহমান নিহত হন।
নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. ফারহান তানভিরুল ইসলাম জানান, “সকাল ৯টার দিকে হাবিবুরকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। তার বুকে একটি ক্ষতচিহ্ন দেখা গেছে, যা সম্ভবত গুলির আঘাত। ময়নাতদন্তের রিপোর্টের পর মৃত্যুর সঠিক কারণ নিশ্চিত হওয়া যাবে।” তিনি আরও জানান, আহতদের মধ্যে পাঁচজনের অবস্থা গুরুতর, এবং তাদের চিকিৎসা চলছে। আহতদের মধ্যে মমিনুর (২৫), শাহিন (২৬), নুর আলম (৩০), মোস্তাক (২৬), লিপি আক্তার (২৬), জামিলা খাতুন (৩৫) এবং পথচারী রব্বানী (২৯) উল্লেখযোগ্য।
শ্রমিক লিপি আক্তার অভিযোগ করেন, “আমরা কাজে যোগ দিতে গিয়েছিলাম, কিন্তু গেট বন্ধ ছিল। হঠাৎ পুলিশ ও সেনাবাহিনী আমাদের ওপর হামলা চালায়। একজন নারী শ্রমিককে মারধর করা হচ্ছিল, আমরা প্রতিবাদ করলে গুলি চালানো হয়। আমাদের একজন ভাইকে হারালাম, এর দায় কে নেবে?” আরেক শ্রমিক মো. রায়হান বলেন, “আমরা কেবল আমাদের ন্যায্য অধিকার চেয়েছি। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে কেন এমন নির্মম হামলা হলো?”
৫৬ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস এম বদরুদ্দোজা জানান, “পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছি। প্রশাসন ও কারখানা মালিকদের সঙ্গে আলোচনা চলছে।” তিনি আরও জানান, উত্তরা ইপিজেডের সব কারখানা আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে।
শ্রমিকরা অভিযোগ করেন, কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের পাওনা পরিশোধ না করে অযৌক্তিকভাবে ছাঁটাই করেছে। তারা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা সত্ত্বেও ন্যায্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত। শ্রমিক মমিনুর রহমান বলেন, “ইপিজেড কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের স্বার্থের চেয়ে মালিকদের পক্ষ নেয়। আমাদের ন্যূনতম অধিকারও নিশ্চিত করা হয় না।”
নীলফামারী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এম আর সাঈদ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করলেও বিস্তারিত মন্তব্য করতে রাজি হননি। উত্তরা ইপিজেডের মহাব্যবস্থাপক জানান, তারা শ্রমিক ও কারখানা মালিকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন। তবে কারখানা কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বর্তমানে নীলফামারী-সৈয়দপুর মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। শ্রমিকরা মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন। ইপিজেড এলাকায় পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। এই ঘটনায় এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে, এবং শ্রমিকরা তাদের দাবি আদায়ে সরকার ও কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহি দাবি করেছেন।