ঢাকা: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে দলের শীর্ষ নেতৃত্বে আনার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছেন বলে বিবিসি বাংলা জানিয়েছে। গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে বর্তমানে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনা, ভারতের কংগ্রেস দলের 'গান্ধী পরিবারের মডেল' অনুসরণ করে এই পরিকল্পনা করছেন বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
নেতৃত্বের নতুন ত্রিভুজাকার মডেল
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন অনুযায়ী, শেখ হাসিনা এখন তার যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ছেলে জয় এবং দিল্লিতে থাকা মেয়ে পুতুলকে দলের নেতৃত্বে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছেন। এছাড়া তার ছোট বোন শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমানে এই তিনজনের সমন্বয়ে একটি 'ত্রিভুজাকার যৌথ নেতৃত্ব' দলের দৈনন্দিন কাজকর্ম পরিচালনা করছে।
সায়মা ওয়াজেদ পুতুল: পুতুল এখন তার মায়ের সঙ্গে দিল্লিতে থাকছেন এবং রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) থেকে 'অনির্দিষ্টকালের ছুটিতে' যাওয়ার পর তিনি পুরোপুরি রাজনৈতিক কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছেন। এর আগে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দুটি মামলা দায়ের করে, যেখানে তিনি ডব্লিউএইচও-এর আঞ্চলিক পরিচালক পদের জন্য জালিয়াতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং ভুল তথ্য দিয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়। এ মামলার পর তিনি ছুটি নিতে বাধ্য হন। এখন তিনি অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া ভাষণের খসড়া তৈরি, কর্মসূচি ঠিক করা এবং দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করছেন।
সজীব ওয়াজেদ জয়: জয় বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দলের জন্য কাজ করছেন। তার বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে তিনি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন বড় প্রকল্পে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের একাধিক সংস্থা তদন্ত করছে। এর মাঝেই তিনি তার সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে দলের অনুকূলে 'বয়ান তৈরি' (narrative building) এবং বিদেশের সংবাদমাধ্যমে দলের বক্তব্য তুলে ধরার কাজ করছেন।
রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি: শেখ হাসিনার ভাগ্নে ববিও এই নতুন নেতৃত্বের অংশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
দলীয় নেতৃত্ব ও চ্যালেঞ্জ
আশির দশক থেকে একটানা চুয়াল্লিশ বছর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকা শেখ হাসিনা তার অনুপস্থিতিতে কে দলের হাল ধরবেন, তা নিয়ে কখনোই প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। তবে ক্ষমতা হারানোর পর এই 'সাকসেশন প্ল্যান' নিয়ে দলের ভেতরে আলোচনা শুরু হয়েছে বলে বিবিসি বাংলা দাবি করেছে। যদিও দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, এই বিষয়টি নিয়ে দলের অভ্যন্তরে কোনো আলোচনা হয়নি এবং তাদের প্রধান লক্ষ্য বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা।
এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা দলের কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতার ওপর বেশি ভরসা রাখছেন বলে জানা গেছে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক সংসদ সদস্য আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম এবং জাহাঙ্গীর কবির নানক এখন কলকাতায় থেকে শেখ হাসিনার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে দলের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
প্রেক্ষাপট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ
দিল্লির রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিনোদ শর্মা মনে করেন, কংগ্রেসের মতো আওয়ামী লীগও একটি পরিবারকেন্দ্রিক দল, তাই এই ধরনের নেতৃত্বের পরিবর্তন স্বাভাবিক। তিনি বলেন, "বিজেপির সঙ্গে ইদানীং শেখ হাসিনার যতই সুসম্পর্ক থাকুক, বিজেপির মডেল আসলে আওয়ামী লীগের জন্য নয়।"
বর্তমানে আওয়ামী লীগ ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর দলটির নিবন্ধন স্থগিত করা হয়েছে এবং দলের কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা দলটিকে পুনর্গঠন করতে এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি নতুন নেতৃত্ব তৈরি করতে কাজ করছেন বলে মনে করা হচ্ছে।