অনলাইন ডেস্ক । বুধবার, ১ অক্টোবর, ২০২৫
রংপুর জেলার পীরগাছায় অ্যানথ্রাক্স রোগের সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। গত আগস্ট মাসে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে দুজন মারা গেছেন এবং ওই উপজেলায় অন্তত দুই শতাধিক ব্যক্তি অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন বলে স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে। ইতোমধ্যে পীরগাছা ছাড়াও মিঠাপুকুর ও কাউনিয়া উপজেলাতেও এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে।
নমুনা পরীক্ষায় অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত
স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, আগস্টে অসুস্থ গরুর মাংসের নমুনা পরীক্ষা করে প্রাণিসম্পদ বিভাগ প্রথম অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত করে। পরবর্তীতে, আইইডিসিআরের একটি প্রতিনিধিদল গত ১৩ ও ১৪ সেপ্টেম্বর পীরগাছা সদর ও পারুল ইউনিয়নের অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ থাকা ১২ জন নারী-পুরুষের নমুনা সংগ্রহ করে। এর মধ্যে ৮ জনের শরীরে অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়েছে।
একইসঙ্গে রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় মিঠাপুকুর ও কাউনিয়া উপজেলা থেকেও নমুনা সংগ্রহ করা হয়। রংপুর জেলা স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক আরবিন্দু কুমার মোদক সময় সংবাদকে জানান, মিঠাপুকুর উপজেলার চারজনের নমুনা পরীক্ষায় একজন অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়েছেন। এ ছাড়াও কাউনিয়া উপজেলার পাঁচজনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে, যার রিপোর্ট এখনও পাওয়া যায়নি।
তিনি আরও বলেন, "আমরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছি। উপজেলাগুলোতে আমাদের স্বাস্থ্য সহকারীদের নমুনা সংগ্রহের প্রশিক্ষণ দিয়েছে আইইডিসিআর। আক্রান্তের খবর পেলেই তারা নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরকে পাঠাচ্ছে। একইসঙ্গে অ্যানথ্রাক্স সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার কাজও অব্যাহত রেখেছে স্বাস্থ্য বিভাগ।"
ছাগলের মাংসে জীবাণু, স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগ
আইইডিসিআর সূত্র বলছে, ফ্রিজে রাখা গরুর মাংসেও অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু পাওয়া গেছে। এমনকি অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হওয়া একজন ছাগলের মাংসের সংস্পর্শে এসেছেন বলেও সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আগে রংপুরে অ্যানথ্রাক্সের তেমন সংক্রমণ ছিল না। কিন্তু গরুর পাশাপাশি ছাগলের মাংসেও অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু শনাক্ত হওয়ায় মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
পীরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তথ্য অনুযায়ী, অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে এখন পর্যন্ত শতাধিক রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন। এ ছাড়াও অনেকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে না এসেও বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন।
এ বিষয়ে পীরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মুহাম্মদ তানভীর হাসনাত বলেন, "আক্রান্ত এলাকায় মেডিকেল টিম গিয়েছিল, যারা আক্রান্ত, তারা যাতে শঙ্কিত না হন, এ জন্য তাদের সচেতন করতে কাজ অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যে আক্রান্তদের বেশিরভাগই সুস্থ হয়েছেন। আর যেন কেউ আক্রান্ত না হয় সে ব্যাপারে আমরা কঠোর নজরদারি রেখেছি।"
চিকিৎসা ও প্রতিরোধে পদক্ষেপ
চিকিৎসকরা জানান, অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত গবাদিপশুর শ্লেষ্মা, লালা, রক্ত, মাংস, হাড় বা নাড়িভুঁড়ির সংস্পর্শে এলে মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এই রোগ গবাদিপশু থেকে মানুষে ছড়ায়, তবে মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না। মানুষের শরীরে এ রোগের প্রধান লক্ষণ হচ্ছে চামড়ায় ঘা সৃষ্টি হওয়া।
রংপুরের ডেপুটি সিভিল সার্জন রুহুল আমিন বলেন, "যারা আক্রান্ত তাদের চিকিৎসার জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পর্যাপ্ত অ্যান্টিবায়োটিক মজুত আছে। তবে রোগটি যেহেতু প্রাণী থেকে আসে, এটি প্রতিরোধে মূল কাজ হচ্ছে প্রাণিসম্পদ দফতরের।"
পীরগাছা সদর, পারুল, ছাওলা ও তাম্বুলপুর ইউনিয়নের বাসিন্দাদের দাবি, গত দুই মাসে অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত হয়ে অন্তত এক হাজার গবাদিপশু মারা গেছে।
তবে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আবু ছাইদ এই দাবি নিয়ে বলেন, "জেলায় ১৩ লাখের বেশি গবাদিপশু রয়েছে। গত ২৬ আগস্ট সময় টেলিভিশনে রিপোর্ট হওয়ার পর থেকে রোগ প্রতিরোধে কাজ করছে প্রাণিসম্পদ বিভাগ। এখন পর্যন্ত পীরগাছা, কাউনিয়া, মিঠাপুকুর ও রংপুর সদরে এক লাখ ৬৫ হাজার গবাদিপশুকে অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধী টিকা দেওয়া হয়েছে।" তিনি ছাগলের মাংসে অ্যানথ্রাক্স শনাক্তের বিষয়টি জেলা সিভিল সার্জন তাকে জানাননি বলে দাবি করেন এবং বলেন, ছাগল অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্তের হার খুব কম। তিনি অ্যানথ্রাক্স নিয়ে আতঙ্কের কারণ নেই বলেও জানিয়েছেন।
অ্যানথ্রাক্স: লক্ষণ ও সতর্কতা
অ্যানথ্রাক্স (স্থানীয়ভাবে যা উল সাজানোর রোগ বা ম্যালিগন্যান্ট পুস্টুল নামে পরিচিত) হলো ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট মারাত্মক সংক্রমণ। এটি প্রধানত তিনভাবে হয়ে থাকে—ত্বকের (কিউটেনিয়াস), শ্বাসনালী (ইনহেলেশনাল) এবং পরিপাকতন্ত্র/পেট সংক্রান্ত (গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল) অ্যানথ্রাক্স।
ত্বকের অ্যানথ্রাক্স: প্রথমে চুলকানিযুক্ত ছোট একটি ঘা দেখা যায়, যা পরে ফোস্কা ও কালো কেন্দ্রবিশিষ্ট আলসারে পরিণত হয়।
শ্বাসনালী অ্যানথ্রাক্স: প্রাথমিকভাবে ফ্লু-এর মতো লক্ষণ (জ্বর, কাশি) দেখা যায়, যা পরে শ্বাসকষ্ট ও গুরুতর জটিলতা সৃষ্টি করে।
গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল অ্যানথ্রাক্স: বমি, তীব্র পেট ব্যথা ও রক্তমিশ্রিত দস্ত দেখা যেতে পারে।
সতর্কতা: আইইডিসিআরের পরিচালক মেহেরজাদী সাবরিনা ফ্লোরা জানিয়েছেন, সংক্রামিত পশু (গরু, ছাগল, ভেড়া), তাদের দেহাংশ বা পশুপণ্য (চামড়া, উল) থেকে মানুষের সংক্রমণের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। আক্রান্ত পশুর কাঁচা বা অপূর্ণভাবে রান্না করা মাংস খেলে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল অ্যানথ্রাক্সের ঝুঁকি থাকলেও, সম্পূর্ণরূপে রান্না করলে জীবাণু টিকে থাকার সম্ভাবনা কম।
করণীয়:
সন্দেহভাজন বা অসুস্থ পশু এবং তাদের দেহাংশ থেকে দূরে থাকতে হবে।
পশু জবাই ও মাংস কাটাকাটির সময় গ্লাভস এবং সুরক্ষা ব্যবহার করতে হবে।
পশু পালনে যুক্তরা নিয়মিতভাবে তাদের পশুকে অ্যানথ্রাক্স টিকা করিয়ে নেবেন।
অ্যানথ্রাক্স সন্দেহভাজন মৃত পশু দ্রুত মাটির নিচে পুতে দিতে হবে এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে।
অস্বাভাবিক ত্বকের ঘা, জ্বর বা শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে হবে।